দাম্পত্য জীবনে ভালোবাসা |
অফিসের কাজ নিয়ে অনেক ব্যস্ততা। অন্য কোন কিছু করার জন্য হাতে এক মুহূর্তও সময় নেই। এর মধ্যে টেবিলের ফোনটি বেজে উঠাতে একটু বিকক্তিবোধ করল। তবুও ফোনটা হাতে নিয়ে বলল,
হ্যালো
বাদল বলছি।
অপর
প্রান্ত থেকে শোনা গেল একটি মেয়েলি কন্ঠস্বর।
স্যার,
আজ আমাদের চেয়াম্যান স্যার অফিসে আসবেন। তাই এমডি স্যার বলে গেছেন সব কিছু ঠিকঠাক ভাবে ঘুছিয়ে রাখতে।
ঠিক
আছে, আমি দেখছি বলে সে ফোনটা রেখে
দিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার সেল ফোনটি বেজে উঠল। কিছুটা ইতস্তত করে মোবাইলটা হাতে নিয়ে পরিচিত নম্বর কিনা তা দেখে নিল।
হ্যা, পরিচিতি নম্বর।
হ্যালো-
কি মনে করে?
কি
মনে করে মানে? তুমি জাননা আজ আমাদের প্রথম
বিবাহ বার্ষিকী?
ও
মাই গড! আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম!
হ্যা,
ভুলেই তো যাবে, কবে
যে আমাকেও ভুলে যাবে এর কোন নিশ্চয়তা
কে দিবে?
ছি!
লক্ষীটি এই কথা বলতে
নেই। পৃথিবীর সবকিছুকে ভুলে গেলেও তোমাকে ভুলতে পারব না । তোমাকে
ছাড়া এ জীবনে ভাবতে
কি পারি? তুমি শুধু রবে আমারই।
হয়েছে,
হয়েছে আর অভিনয় করতে
হবে না।
এই
শোন, তুমি কি আজ তাড়াতাড়ি
বাসায় আসতে পারবে? আমার খুব ইচ্ছা তোমাকে নিয়ে আজ সারাদিন ঘুরে
বেড়াবো।
আজ
ছুটি নিয়ে একটু তাড়াতাড়ি বাসায় চলে আস প্লীজ!
আমারও
তোমাকে নিয়ে খোলা আকাশের নীচে বাইরের সুনির্মল আলো ছায়া উপভোগ করতে খুব ইচ্ছে করে মিনা। কিন্তু মানুষের সব ইচ্ছাই কি
পূর্ণ হয়? তবুও মানসিক ভাবে তুমি প্রস্তুত হয়ে থেকো আমি আসতে চেষ্টা করবো।
এরপর বাদল আবার তার স্বকাজে মনোযোগ দিলো। কাজ করতে করতে সে ভুলেই গিয়েছিল বিকালে বর্ষার সাথে বাইরে যাবার কথাটি। যখন হঠাৎ মনে পড়ল তখন ঘড়িতে সাড়ে ছয়টা সংকেত দিল। এদিকে বর্ষা আজ খুব মজার মজার খাবার রান্না করেছে। মনে আনন্দ নিয়ে সবকিছু করার পড় যখন দেখল বাদল ঠিক সময় আসছেনা তখন তার প্রতিক্ষীত ক্লান্ত দেহ ও মন রাগ ও অভিমানে ভরে গেল। অপেক্ষা যে কত কষ্টের তা বাদল বুঝতে পারল না। মানুষ কেন এমন হয় তা একমাত্র বিধাতাই জানেন। বাদলের বাড়িতে ফিরতে আরও কিছুটা রাত হয়ে গেল। কারণ সে মার্কেটে গিয়েছিল বর্ষার জন্য কিছু উপহার কিনতে। তারপর একগুচ্ছ রজনীগন্ধা ফুল আনতে ভুলে যায়নি।
বাদল
ঘরে ঢুকেই বলল, সরি বর্ষা, আমি আমার কথা রাখতে পারিনি। আমাকে ক্ষমা করে দাও প্লীজ!
বর্ষা বাদলের দিকে একটুও ফিরে তাকাচ্ছেনা। কারণ তখন তার দু’চোখের কোণে
দুফোটা অশ্রু জমে ছিলো। যে কোন সময়
তা গড়িয়ে পড়তে পারে দু’গাল বেয়ে।
একারনেই সে বাদলের দিকে
তাকাচ্ছেনা।
বাদল
নিজেই বর্ষার মুখটা তার দিকে ঘুরিয়ে বলল, কী এখনও ক্ষমা
করলে না?
কিন্তু
কি আশ্চর্য! বর্ষার দু’চোখ থেকে
অশ্রু গড়িয়ে পড়তে দেখে
বাদল মিষ্টি হাসি দিয়ে বলে উঠল,
ছি!
পাগলি মেয়ে দেখ, এর জন্য বুঝি
কাঁদতে হয়?
তারপর
নিজ হাতে তার চোখের জল মুছে দিল।
বাদলের আদরমাখা ভালোবাসায় মুগ্ধ হয়ে বর্ষা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসলো। তারপর বাদলকে বলল, যাও হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে আসো আমি খাবার দিচ্ছি।
যাচ্ছি
ম্যাডাম যাচ্ছি, কিন্তু এর আগে একটু.......।
তোমার
নেকামিটা এখন রাখ।
না
ম্যাডাম, নেকামি নয় জাস্ট একটু
ভালোবাসা।
তারপর বর্ষাকে সে চোখ বন্ধ
করতে বলল।
বর্ষাও
লক্ষী ও বাধ্য মেয়ের
মতো চোখ বন্ধ করল। বাদল উপহার ও ফুল বর্ষার
সামনে এনে
চোখ খুলতে বলল।
বর্ষা চোখের সামনে ফুল ও উপহার দেখে
আশ্চর্য হয়ে বলল-
এতকিছু
আনতে গেলে কেন?
এত কিছুর
কী দেখলে? এই সামান্য কিছু
আমার চিরজীবনের মানুষটির জন্য আনলাম। যে সুখে, দুখে,
ধনে দারিদ্র্যে সব সময় আমার
পাশেই থাকবে।
তুমি
আমার জন্য এতকিছু করলে আর আমি তোমার
জন্য কিছুই
করতে পারিনি।
আমার
কিছু লাগবেনা, তুমিই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার ।
কথাটা
বলেই বাদল আদর ও ভালোবাসার চিহ্ন
অঙ্কন করে দিল।
এরপর দিনের পর রাত রাতের পর দিন আসছে ও যাচ্ছে বর্ষ পরিক্রমা অনুসারে। বাদলের ব্যস্ততা আরও বেড়ে যাওয়ার প্রায়ই সে রাত করে বাসায় ফিরত। সারাদিনের কর্মব্যস্তায় ক্লান্ত হয় অবসন্ন থাকে দেহমন এর জন্য বাসায় ফিরেও বেশি কথা বলতে ইচ্ছে করেনা তার। তাই চুপচাপ টিভির সামনে বসে বাকি সময় অতিবাহিত করার পর রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে। এদিকে বর্ষা সারাদিন বাসায় একা থাকে। কথা বলবে এমন কেউ নেই। তাই বাদল যখন অফিস থেকে ফিরে আসে তখন প্রাণ খুলে কথা বলতে ইচ্ছে হয় তার। কিন্তু বাদল তাতে কিছুটা বিরক্তিবোধ করত। এভাবে প্রতিদিনের নিঃসঙ্গতা ও একাকীত্ব মুহূর্তগুলো তাকে কষ্ট দিয়ে যাচ্ছিল। তার খুব ইচ্ছে হতো বিয়ের আগে বাদলের সাথে যেভাবে ঘুরে বেড়াত ঠিক সেভাবেই এখনো ঘুরে বেড়াতে। কিন্তু বাদলের সে সময় আর হতো না।
একদিন
এক অপরাহ্নে বাদল অফিসের কাজে বাইরে বেরিয়েছিলো। রাস্তাটি ছিল পার্কের পাশ ঘেঁসে। সে হাটছিল আর
পার্কের বিচিত্র ধরণের যুগলগুলোকে দেখছিল। হঠাৎ এক যুগলের দিকে
চোখ পরতেই সে আশ্চর্য হয়ে
গেল। মেয়োটকে কেমন যেন চেনা চেনা মনে হলো। যুগল দুটি মুখোমুখি এবং কাছাকাছি বসা। কী সব কথা
বলছে আর হাসাহাসি করছে।
কিন্তু একি! সে যখন তাদের
খুব কাছাকাছি অবস্থানের উপর দিয়ে যাচ্ছিল তখন তার নিজের চোখকে সে বিশ্বাস করতে পারছিলোনা। একটু দাঁড়িয়ে সে যখন ভালো
করে তাকিয়ে
দেখল; তার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। তবুও কেন যেন সে বিশ্বাস করতে
পারছিলনা তার চোখকে। আবার এতদিনের ভালোবাসার মানুষকে চিনতে পারবেনা তাও মেনে নিতে পারছিলনা। যে মানুষ তাকে
ছাড়া কিছুই ভাবেনি সেই আজ পার্কে বসে
অন্য পুরুষের সাথে আড্ডা দিচ্ছে হাসাহাসি করছে। ভাবতে গিয়েই তার মন কান্নায় ভেঙ্গে
পড়ল।
তারপর
সেদিন আরো অনেক রাত করে বাসায় ফিরল সে। বাসায় পৌঁছা মাত্রবর্ষা জিজ্ঞেস করল,
আজ
এত দেরি করলে যে?
একটু
বিষন্ন ও ক্লান্ত মনে
বাদল উত্তর দিল, অফিসের কাজে বাইরে গিয়েছিলাম তাই একটু দেরি হয়ে গেল।
তোমাকে
বিষন্ন মনে হচ্ছে শরীর খারাপ নাকী?
শুকনো
মুখে বাসি ফুলের ন্যায় হাসি দিয়ে বাদল বলল,
কই,
না তো আমি সম্পূর্ণ
সুস্থ আছি।
বর্ষাকে
আজ অনেকদিন পর একটু অন্য
রকম উচ্ছল দেখাছিল।
রাত
গভীর হলেও বাদলের
দু’চোখের পাতা যেন এক হতে চাচ্ছেনা।
তার ঘুম হারিয়ে গেছে রাতের অন্ধকারে। তারপর দু’জনের অতীত
বর্তমান ইত্যাদি ভাবতে ভাবতে সেও কখন যেন ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুমের ঘোরে সে সপ্ন দেখলো
তার এক বন্ধু তাকে
বলছে-
বন্ধু তুমি তোমার স্ত্রীকে সাধ্যমত সবকিছু দিচ্ছ, কোন কিছুর অভাব রাখোনি। কিন্তু তুমি তাকে যা কিছু দিচ্ছ সেগুলো
তো বাহ্যিক। দাম্পত্য জীবনে যে প্রেম ভালোবাসার আদান প্রদান সেইটা থেকে তুমি তাকে বঞ্চিত
করছো। মানুষের জন্য অর্থ সম্পত্তির প্রয়োজন সব সময় আছে এবং চিরজীবন থাকবে। কিন্তু ভালোবাসার
উপরে কিছু নেই। ভালোবাসা মানুষকে সুখ ও আনন্দ দেয়। আর তুমি তাকে সেই ভালোবাসা সেই সময়
গুলো যথেষ্ট দিচ্ছ না। যার জন্য সে অধীর
আগ্রহে তোমার দিকে তাকিয়ে থেকে। সে তোমাকে অনেক
বেশি
ভালোবাসে আর সে এটাও জানে তুমি কত ব্যস্ত থাকো। তবুও স্ত্রী
হিসেবে একটু ভালোবাসা একটু সময় দেওয়া নেওয়া তোমার কাছ আশা করতেই পারে। সে নির্মল ও পবিত্র হৃদয়ের মেয়ে। তুমি আগে যেভাবে তাকে ভালোবাসতে ও সময়
দিতে,
ঠিক
সেভাবেই তুমি
আবার
তাকে
তোমার
ভালোবাসা দাও।
আর তা-না হলে
তুমি
তাকে
হারাবে। আর সে তোমার জীবন থেকে হারিয়ে গেলে তুমি পাগল হয়ে যাবে।
এর
পরেই বাদলের ঘুম ভেঙ্গে যায়। এই শীতের মধ্যেও
তার শরীর থেকে ঘাম বেরুচ্ছিল। তারপর সে বর্ষার মুখের দিকে
তাকিয়ে দেখল কি নিস্পাপ শিশুর
মত ঘুমিয়ে আছে সে। কয়েকটি এলোমেলো চুল তার মুখের উপরে পড়ে আছে। কি অপূর্ব লাগছিল
তখন তাকে। কোটি কোটি তারার দ্যুতিমান সেই মুখের দিকে নিঃসঙ্কোচে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকল সে। কি সুন্দর, নিষ্পাপ
নিঃস্কলঙ্ক মুখ। চাঁদের কলঙ্ক আছে কিন্তু মিনার মুখে কলঙ্কের ভাঁজও যেন নেই। অন্ধকারের ডিমলাইটের আলোতে তাকে দেবীমূর্তির মত দেখাচ্ছিল।
পরদিন
সকালে ঘুম থেকে উঠেই বর্ষাকে বলল,
আজ
তোমাকে সারপ্রাইজ দিব।
সারপ্রাইজটা
কী জানতে পারি?
আগে
তুমি রেডি হয়ে নাও তারপর বলবো।
কিছু
না জেনে না বুঝে আমি
কিভাবে রেডি হবো?
ঠিক
আছে বলছি- আজ আমরা বাইরে যাচ্ছি
আর সারাদিন ঘুরে বেড়াবো। যেদিকে দুচোখ যাবে সে দিকেই চলে যাব।
কথাগুলো
শুনে বর্ষা বলল, আজ বুঝি সূর্য
দক্ষিন দিক দিকে উঠেছে?
সূর্য
দক্ষিন, পশ্চিম ও পূর্ব যে দিক থেকে
উঠুক না কেন আমরা
আজ বাইরে যাবই। আর শুনো, আজ
তোমাকে কষ্ট করে কিছু রান্নাও করতে হবেনা। আজ আমরা বাইরে
খেয়ে নিবো।
অনেকদিন
পর বাদলের কাছ থেকে এমন মধুর কথা গুলো শুনে বর্ষা আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়ল। আনন্দে নেচে উঠলো তার হৃদয় মন। তাই বাদলের
দুটি হাত ধরে রবীন্দ্রনাথের
এই গানটি গেয়ে উঠলো-
“আমি
বহু বাসনায় প্রাণপনে চাই
বঞ্চিত করে বাঁচালে মোরে
এ
কৃপা কঠোর সঞ্চিত মোর জীবন ভরে”।
সারাদিন
ঘুরাঘুরি খাওয়া দাওয়া করে দিনটা খুব সুন্দর ভাবে কেটে গেল তাদের। এরপর বিকেলে মার্কেটে গিয়ে অনেক কিছু কেনাকাটা করল। বর্ষা স্বার্থপরের মতো শুধু নিজের জন্য সবকিছু লুফে নেয়নি। বাদলের বাধা সত্বেও সে বাদলের জন্য
নিজের পছন্দ মতো অনেক কিছু কিনে আনলো। এতে বাদল বিরক্ত না হয়ে বরং
স্বামীর প্রতি স্ত্রীর ভালবাসা দেখে মুগ্ধ হলো।
সেদিনের
পর থেকে বাদলের শত ব্যস্ততা থাকা
সত্বেও বর্ষার জন্য সময় বের করে নিত। মিনার জন্মদিন ও তাদের বিবাহ
বার্ষিকীতে ফুল ও উপহার আনতো।
এছাড়াও বর্ষাকে সর্বদা খুশি রাখতে ভালো ভালো বই ও তার প্রিয়
জিনিস গুলো না চাইতেই এনে
দিতো। এভাবে তাদের দাম্পত্য জীবনের পঁচিশটি বছর পার হলো। বর্ষা কিন্তু এখনো জানতেই পারেনি সেদিনের সেই পার্কের ঘটনার কথা। বাদল তার ভালোবাসার চোখ দিয়ে দেখেছে বলেই তা তার মন
থেকে মুছে ফেলেছে। এভাবেই নিঃশর্ত ভাবে আনন্দ মনে
তারা জয় করে নিল
তাদের দাম্পত্য জীবনের পঁচিশটি বছরের ভালোবাসাকে।
2 Post a Comment:
WOW! WONDERFUL
গল্পটি পড়ে খুব ভালো লাগলো। মানুষের জীবনের বাস্তব চিত্র খুব সুন্দর করে লেখনির মাধ্যমে ফুটিয়েছ।
Post a Comment